অমৌসুমে তরমুজ চাষ
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তরমুজ সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম। কিন্তু সম্প্রতি এ দেশের বাজারে এ সময় ছাড়া অন্য সময়েও তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তরমুজ বেশি পাওয়া যায়। এ তরমুজকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘বারোমাসি তরমুজ’। ছোট, লম্বাটে, ডিম্বাকার, কালো খোসা, ভেতরে টকটকে লাল শাঁসের তরমুজগুলো অসময়ে ওঠার কারণে বাজারে চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। কোনো স্থানে হলুদ রঙের খোসার অমৌসুমী তরমুজেরও চাষ হচ্ছে। দিন দিন অমৌসুমে তরমুজ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হবিগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, ভোলা প্রভৃতি জেলায় কিছু কৃষক ইতোমধ্যে এই বারোমাসি তরমুজ চাষ করে বিঘাপ্রতি প্রায় দেড় লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। এক বিঘায় এ জাতের তরমুজের ফলন হয় প্রায় ৬ থেকে ৮ টন।
জাত : ছোট আকারের বারোমাসি তরমুজের বেশ কয়েকটি জাতের বীজ এ দেশে এখন পাওয়া যাচ্ছে। এসব জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্লাক বেবী, ব্লাক প্রিন্স, ব্লাক বক্স, জেসমিন ১, জেসমিন ২, জেসমিন ৩ ইত্যাদি। এসব জাত বছরের যে কোনো সময় চাষ করা যায়।
চারা রোপণ
মধ্য মার্চ থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ জাতের তরমুজের চারা লাগানো যায়। বিঘায় মাত্র ৫০ গ্রাম বীজ লাগে। বিঘায় ১৪০০টি চারা লাগে। জমি তৈরির আগেই পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করে নিতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে শতকরা ১০ ভাগ চারা বেশি উৎপাদন করতে হবে।
চারা তৈরি
চারা উৎপাদনের জন্য সন্ধ্যাবেলায় ৪-৬ ঘণ্টা বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পানি ঝরিয়ে বীজ শুকিয়ে সুতি কাপড়ের মধ্যে রেখে ভাঁজ করে চটের বস্তায় তা আবার ভাঁজ করে মুড়িয়ে রাখতে হবে। বীজসহ চটের বস্তা ৩০-৪৫ ঘণ্টা রোদে জাগ দিয়ে রাখতে হবে। চটের বস্তায় পানি ছিটিয়ে মাঝে মাঝে তা ভিজিয়ে দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে চটের বস্তায় রাখা বীজ গজিয়ে যাবে। পলিব্যাগ বা প্লাস্টিকের কাপ-ট্রে তে চারা তৈরি করা ভালো। তবে এখন নানা সুবিধা ও কম খরচের কারণে অনেকেই প্লাস্টিকের ট্রে ব্যবহার করছেন। একটি ট্রে-তে ১০০টি চারা তৈরি করা যায়। এই ট্রের সুবিধা হলো, যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে স্থানান্তর করা যায়, বৃষ্টি থেকে সহজে রক্ষা করা যায় ও বারবার ব্যবহার করা যায়।
গজানো বীজ পলিব্যাগে ফেলার জন্য পলিব্যাগে গোবর সার মেশানো মাটি ভরে রাখতে হবে। মাটিভরা পলিব্যাগগুলো রোদপড়া কোনো জায়গা পরিষ্কার ও সমতল করে সেখানে ১ মিটার চওড়া করে জায়গা নিয়ে চারপাশ বাঁশের চটা দিয়ে ঘিরে বীজতলার জন্য বেড তৈরি করতে হবে। চারপাশে চারটি বাঁশের ছোট খুঁটি পুঁতে ও মাঝে মাঝে আরও কয়েকটি খুঁটি পুঁতে তার সাথে আড়ার মতো বাঁশের চটা বেঁধে এই বেড তৈরি করা যায়। বেডের চারপাশে চটার উচ্চতা মাটি থেকে ৪-৬ ইঞ্চি বা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হতে পারে। এসব ঝামেলা না করে শুধু চারপাশে চার টুকরো বাঁশ দিয়ে ঘিরেও পলিব্যাগের ঠেকনা দেয়ার কাজ বা বেড তৈরি করা যেতে পারে।
গজানো বীজ চট থেকে বের করে একটা একটা করে এক একটি পলিব্যাগের মাটিতে অল্প গভীরে বপন করতে হবে। বপনের আগে প্রতিটি পলিব্যাগের মাঝখানে একটা কাঠি দিয়ে সামান্য গর্ত করে রাখতে হবে। পলিব্যাগে বীজ বপনের আগে গজানো বীজের সাথে সামান্য শুকনো ঝুরঝুরে মাটি মিশিয়ে নিলে বীজ বপনে সুবিধা হবে। অংকুর বের হওয়া মুখ নিচের দিকে দিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হবে। তারপর তা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পলিব্যাগে বীজ বপন শেষ হলে ওপর থেকে হালকা করে ঝাঝরি দিয়ে পানি ছিটাতে হবে। ভারী বৃষ্টি যাতে চারার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য বীজতলা বা বেডের ওপরে বাঁশের চটা দিয়ে নৌকার ছৈয়ের মতো করে পলিথিনের ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি বা কড়া রোদ থেকে এই ছাউনি চারাকে রক্ষা করবে।
জমি ও বেড তৈরি : জমিতে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। চারপাশের আইল থেকে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার চওড়া করে লম্বা বেড করতে হবে। জোড়া সারি পদ্ধতিতে বেড তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে প্রথমে ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া একটা বেড করতে হবে, তারপর ২.৫ মিটার জায়গা খালি রাখতে হবে। এরপর আবার ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া আর একটি বেড করতে হবে। এভাবে পাশাপাশি দুটো জোড়া বেড তৈরি হবে যার মাঝে ৬০ সেন্টিমিটার খালি থাকবে, যা সেচনালা ও পরিচর্যার চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হবে। আড়াই মিটার ফাঁকা জায়গায় তৈরি হবে মাচা। দুই বেডের মাঝের ফাঁকা জায়গার মাটি তুলে পাশের বেডে তুলে দিয়ে বেড উঁচু করতে হবে। কেউ কেউ এখন নিচু ধানের জমিতেও বারোমাসি তরমুজের চাষ করে এখন লাভবান হচ্ছেন।
সার প্রয়োগ
বারোমাসি তরমুজ চাষের জন্য ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার ভালো হবে। বিঘাপ্রতি সার লাগবে- ভার্মিকম্পোস্ট ২০০ কেজি, ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি ৪০ কেজি, এমওপি ৪০ কেজি, জিপসাম ২০ কেজি, জিংক সালফেট ১ কেজি ও বোরণ সার ১.৫ কেজি। সব সার বেড তৈরির সময় বেডের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
পলিথিন মালচিং
বারোমাসি তরমুজ চাষের জন্য বেড ঢাকতে কালো রঙের পলিথিন শিট দিয়ে মালচিং করতে হয়। এক বিঘা জমির জন্য ১১ কেজি ওজনের একটি পলিথিন রোল দরকার হয়। পলিথিন রোল ৩ ফুট বা ১ মিটার চওড়া হলে চলে। মালচিং শিট বা পলিথিন বিছানোর জন্য বিশেষ দক্ষতার দরকার হয়। বেডের এক পাশ থেকে মালচিং শিট বিছানো শুরু করতে হবে। রোলের মাঝে একটা চিকন বাঁশ বা পাইপ ঢুকিয়ে নিলে রোল টানতে সুবিধা হয়। মালচিং শিট বিছাতে ৩-৪ জন লোক হলে ভালো হয়। দু’জন রোল টানবে, এক বা দু’জন শিট বিছানোর পর বেডের দুইপাশ থেকে মাটি তুলে পলিথিনের পাশটা মাটিচাপা দিয়ে বেডের সাথে চেপে দেবে। মালচিং শিট যে প্রান্ত থেকে বিছানো শুরু করতে হবে সে প্রান্তে শিটের ধারটা বেড থেকে কিছুটা বাইরে বের করে মাটিচাপা দিয়ে আটকে দিতে হবে। টানার সুবিধার্থে সেই প্রান্ত দুটো বাঁশের খুঁটার সাখে বেঁধেও দেয়া যেতে পারে। মাটিচাপা দেয়া ও বেডে পলিথিন শিট বিছানোর পর খুঁটা তুলে ফেলা যেতে পারে। মালচিং শিট স্থাপনের পর জমি সেচ দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে।
চারা রোপণ
সেচ দেয়ার ৭-৮ দিন পর জমিতে ‘জো’ অবস্থা এলে চারা রোপণের কাজ শুরু করতে হবে। চারা রোপণের আগে নির্দিষ্ট দূরত্বে বেড বা পলিথিন মালচিং শিটের মাঝখান বরাবর ১০ সেন্টিমিটার বা ৪ ইঞ্চি ব্যাসের গোলাকার ছিদ্র করতে হবে। সহজ ও কম সময়ে, কম শ্রমে এ কাজ করতে চাইলে শক্ত ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা এক টুকরো ৪ ইঞ্চি ডায়ার পিভিসি পাইপ দিয়ে এ কাজ করা যেতে পারে। এই পাইপের টুকরা নির্দিষ্ট স্থানে চেপে ধরে মোচড় দিলেই পলিথিন গোল করে কাটা হয়ে যাবে। কাটা ফাঁকা স্থানের মাটিতে চারা লাগানোর জন্য ছোট্ট গর্ত তৈরি করতে হবে। একটি গর্ত থেকে আর একটি গর্তের দূরত্ব হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা ১৮ ইঞ্চি। কাটা পলিথিনের টুকরা জমি থেকে কুড়িয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, জমির ভেতরে রাখা যাবে না।
জমিতে ৫-৭ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের আগে দেখতে হবে পলিব্যাগের মাটিতে রস আছে কিনা। না থাকলে মাটি চারা রোপণের কিছুক্ষণ আগে হালকা করে ভিজিয়ে দিতে হবে। ব্লেড দিয়ে পলিব্যাগ কেটে বা পলিব্যাগের নিচে টিপ দিয়ে চেপে পলিব্যাগ থেকে চারা বের করা যায়। চারা রোপণের পর চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে। বিকেলে চারা লাগানো ভালো।
মাচা তৈরি
দুই বেডের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বাঁশ ও নাইলন রশি বা জিআই তার ব্যবহার করে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। দোচালা ঘরের চাল বা নৌকার ছৈয়ের মতো মাচা তৈরি করা যায়। এতে দুইপাশের বেড থেকে গাছ উঠতে সুবিধা হয়। প্রথমে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে তার ওপর ২০ সেন্টিমিটার বা ৮ ইঞ্চি দূরে দূরে তার বা রশি লম্বা করে টানিয়ে ফ্রেমগুলোর ওপর টেনে দিতে হবে। এরপর নাইলনের নেট বিছিয়ে দিতে হবে।
কুশিছাঁটা
মোট তিনবার কুশি ছাঁটতে হবে। প্রথমবার ছাঁটতে হবে মাচায় চারা তুলে দেয়ার সময়। মূল গাছের সাথে দুটি কুশি রেখে বাকিগুলো গোড়া থেকে ছেঁটে দিতে হবে। দ্বিতীয়বার ছাঁটতে হবে প্রথমবার কুশি ছাঁটার ৫-৭ দিন পর। এ সময় মাচায় নেটের নিচে ঝুলে পড়া কুশি ছেঁটে দিতে হবে। এর ৫-৭ দিন পর একইভাবে নেটের নিচে ঝুলে পড়া কুশিগুলো ছেঁটে দিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা
তরমুজ গাছে বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়। এর মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজ বা শুকনো পচা, ঢলে পড়া, আঠা ঝরা ইত্যাদি প্রধান ক্ষতিকর রোগ। এ ছাড়া ফলের মাছি, লাল মাকড়, সাদা মাছি, থ্রিপস, রেড পাম্পকিন বিটিল, এপিলাকনা বিটিল বা কাঁটালে পোকা, জাবপোকা ইত্যাদি পোকামাকড় আক্রমণ করে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে এসব রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যায়।
ফলে নেট বাঁধা
ফল বড় হওয়া শুরু হলে তা নেট দিয়ে বেঁধে না দিলে ছিঁড়ে পড়ে ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য নেটের ব্যাগ বা নেট দিয়ে ফল বেঁধে দিতে হবে।
ফল তোলা
ফল ধারণের পর ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে ফল তোলার উপযুক্ত হয়ে যায়। এ সময় থেকে শুরু করে ৭০ দিন পর্যন্ত ফল তোলা যায়। এর পর গাছে ফল রাখা উচিত হবে না। য়
প্রকল্প পরিচালক, ডিএই, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট (২য় পর্যায়) প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityun@yahoo.com
রূপসায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ
মোঃ আবদুর রহমান
তরমুজ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পুষ্টিকর ফল। তরমুজের মন কাড়া রং আর রসালো মিষ্টি স্বাদের জন্য সবার কাছে এ ফলটি প্রিয়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বাজারে তরমুজ ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম। ইদানীং এ দেশের বাজারে মৌসুম ছাড়াও অমৌসুমেও এফলটি পাওয়া যাচ্ছে। কম সময়ে, স্বল্প খরচে, অধিক ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
জানা যায়, এ বছর উপজেলার ডোবা, নতুনদিয়া, শিয়ালী, গোয়াড়া, চাঁদপুর, সামন্তসেনা, পাথরঘাটা, তিলক, জাবুসা, হোসেনপুর ও ভবানীপুর গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে রংধনু, রঙ্গিলা, তৃপ্তি, সুগার কিং, কালাচাঁদ, ইয়োলো ড্রাগন এসব হাইব্রিত জাতের অমৌসুমের তরমুজ চাষ হয়েছে। সরেজমিন এসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাছের ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলে আছে হলুদ, কালো ও সবুজ ডোরাকাটা রঙের বাহারি তরমুজ। অনেক কৃষক এসব গাছের পরিচর্যা করছেন। আবার কেউ ফল তুলছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং ব্যাপক চাহিদা থাকায় ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি।
রূপসা উপজেলার নতুনদিয়া গ্রামের চাষি লিটন শিকদার এ বছর অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে তৃপ্তি, রঙ্গিলা ও কালাচাঁদ জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এতে বীজ, মাদা তৈরি, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ তার প্রায় ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বীজ বপনের ৬০ দিন পর থেকে তরমুজ সংগ্রহ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে তিনি এক হাজার কেজি তরমুজ (প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে) পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। আরো প্রায় ৮-১০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। একই উপজেলার সামন্তসেনা গ্রামের কৃষক সোহাগও এবছর ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে দেড় বিঘা জমিতে রংধনু ও রঙ্গিলা জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এচাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। তিনি এ পর্যন্ত ৮০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরো প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। এদিকে উপজেলার জাবুসা গ্রামের চাষি হাফিজ শেখও এ বছর ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে বর্ষা মৌসুমে তৃপ্তি ও রঙ্গিলা নামক হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ঘেরের পাড়ের এ জমি থেকে আরো প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষক এ বছর প্রথম অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রূপসা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস, দেবাশীষ কুমার দাস, নিতীশ বালা ও সোহেল রানা এসব কৃষকদের পাশে থেকে তরমুজ চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এলাকার কৃষকরা বলেন, মৎস্য ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ করে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ঘেরের পাড়ের মাটি বেশ উর্বর। চাষকৃত তরমুজ গাছ চারদিক থেকেই সূর্যের আলো পায়। এতে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও ফলন ভালো হয়। সাধারণত মৎস্য ঘেরের পাড় উঁচু হয়। তাই বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যায়। একারণে বর্ষাকালে ঘেরের পাড়ে খুব সহজে তরমুজ চাষ করা যায়। ঘেরের পাড়ে পানির ওপর মাচা তৈরি করে তা তরমুজ গাছের লতা বাউনির জন্য ব্যবহার করা হয়। একারণে ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে জায়গা কম লাগে। আবার ঘেরে অবাধ পানি সরবরাহ থাকায় গাছে পানি সেচ দিতে সুবিধা হয়। এসময়ে তরমুজে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। তাছাড়া ঘেরের পাড়ের তরমুজ গাছের পরিচর্যা করতেও সুবিধা হয় এবং অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়েছেন এখানকার কৃষকেরা। তাই প্রতি বছর রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কৃষক লিটন শিকদার বলেন, বর্ষার পানিতে ডুবে না যায় এ ধরনের ঘেরের পাড়ের বেলে দো-আঁশ মাটিঁ অমৌসুমে তরমুজ চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। ঘেরের পাড়ে ২ হাত দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে দেড় হাত পর পর ২০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদার ওপরের স্তরের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম ভার্মি কম্পোস্ট, ২৫ গ্রাম টিএসপি, ১৫ গ্রাম এমওপি ও ১০ গ্রাম জিপসাম সার ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা পুনরায় ভরাট করতে হবে। ঘেরের পাড়ের দু’পাশের কিনারে মাদা তৈরি করতে হয়। মাদায় সার প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর প্রতি মাদায় ২টি অংকুরিত বীজ ১ ইঞ্চি (২.৫ সেমি. ) গভীরে বপণ করে ঝুরঝুরে শুকনো মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে অসময়ে তরমুজ বীজ বপন করা হয়। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রতি মাদায় ১টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
তিনি বলেন, অমৌসুমে তরমুজের ভালো ফলনের জন্য ইউরিয়া, এমওপি ও বোরন সার তিন ভাগে ভাগ করে চারা গজানোর ১৫ দিন পর প্রথম, ৩০ দিন পর দ্বিতীয় ও ৪৫ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি কিস্তিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০ গ্রাম এমওপি ও ৫ গ্রাম বোরন সার গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেমি. দূরে চারদিকে উপরিপ্রয়োগ করে ঝুরঝুরে শুকনো মাটি দিয়ে এসব সার ঢেকে দেওয়া হয়। প্রতিবার সার উপরিপ্রয়োগের পর মাদায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। তাছাড়া মাটিতে রসের অভাব হলে তরমুজ গাছে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। আবার গাছের গোড়ায় আগাছা হলে নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে তা তুলে ফেলতে হয়। কৃষক লিটন শিকদার আরো বলেন, ঘেরের পাড়ে তরমুজ গাছের পাতায় লাল বিটল, থ্রিপস, লেদা পোকা ও মাকড় এর আক্রমণ বেশি হয়। লালবিটল পোকা দমনের জন্য একতারা-২৫ ডব্লিউ জি (১০ লিটার পানিতে ২ গ্রাম), থ্রিপস ও লেদা পোকা দমনে টিডো-২০ এসএল (১০ লিটার পানিতে ২.৫ মিলি.), আর মাকড়ের জন্য ভারটিমেক-০১৮ ইসি (১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলি.) বা মিটিসল-৫ ইসি (১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি.) নিয়মিত স্প্রে করা হয় বলে তিনি জানান।
তরমুজ গাছ বা লতা ২০-২৫ সেমি. (৮-১০ ইঞ্চি) লম্বা হলে তা ঘেরের পাড়ে তৈরি মাচায় তুলে দিতে হবে। এতে গাছ মাচায় লতিয়ে বা ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। বীজ বপণের ২৫-৩০ দিন পর গাছে ফুল আসে এবং ৩৫-৪০ দিন পর ফল ধরা শুরু হয়। আর ৬০-৬৫ দিন পর তরমুজ ফল সংগ্রহ শুরু করা হয়। প্রতি গাছে ৩ থেকে ৪টি ফল ধরে এবং এক একটি তরমুজের ওজন হয় গড়ে ১ থেকে ৩ কেজি। ওজন ও আকারে অমৌসুমের তরমুজ সবার দৃষ্টি কেড়েছে। শুধু তাই নয়, এসময়ের তরমুজ খেতে যেমন মিষ্টি স্বাদের, তেমনি পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ফসফরাস রয়েছে। তাই আমাদের দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণে তরমুজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এফল আহারে দেহমনে প্রশান্তি আনে। স্থানীয় বাজারে অমৌসুমে উৎপন্ন তরমুজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এর বাজারমূল্যও বেশি। স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা অসময়ের টাটকা ও তাজা তরমুজ কিনতে পেরে খুব খুশি।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মো: ফরিদুজ্জামান বলেন, ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ হওয়ায় ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই উপজেলায় প্রতি বছর অমৌসুমে তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে হাইব্রিড জাতের তরমুজ বীজ ও সার সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এতে কৃষকদের মধ্যে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে তরমুজ চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত। কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমশ: বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু জমি বাড়ছে না; বরং কমছে। সেই সাথে উর্বরা জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন মাছের ঘের। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে বাস্তবায়নে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব মৎস্য ঘেরের পাড়ে বা বেড়িতে তরমুজ ও অন্যান্য উপযোগী শস্য চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (পিআরএল), উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা। মোবাইল নং- ০১৯২৩৫৮৭২৫৬, ই-মেইল:rahman.rupsha@gmail.com